দামের ঊর্ধ্বগতি ঢাকার বাসিন্দাদের নিত্যদিনের বাজেটে হানা দিয়েছে। তারা কাঁচাবাজার ‘অব্যবস্থাপনার’ জন্য দায়ী করছেন সরকারকে। তাদের অভিযোগ, নগরীর বড় বাজারগুলোতে ব্যবসায়ীরা নিজেরাই দাম ঠিক করে দিচ্ছেন। কিন্তু ব্যবসায়ীরা বলছেন যে কোভিড মহামারির কারণে সরবরাহ কম থাকায় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যে ঊর্ধ্বগতি বজায় রয়েছে।
ইউএনবির এ প্রতিবেদক কাপ্তান বাজার, আনন্দবাজার, যাত্রাবাড়ী, মগবাজার ও সরুলিয়া বাজারে গিয়ে দেখতে পান, ব্যবসায়ীরা প্রতি কেজি বেগুন ৭০-৯০ টাকা, পেঁপে ৩৫-৪০ টাকা, করলা ৮০-৯০ টাকা, লাউ ৫০-৭০ টাকা, শিম ১০০-১২০ টাকা, মুলা ৬০-৭০ টাকা, শসা ৮০ টাকা এবং টমেটো ১২০ টাকা করে বিক্রি করছেন।
বাজারে প্রতি কেজি কাঁচা মরিচের দাম বেড়ে ২০০-২৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। একইভাবে, দাম বেড়ে প্রতি কেজি গাজর ৮০-১০০ টাকা, এক হালি কাঁচা কলা ৪০-৫০ টাকা এবং এক হালি ডিম ৪০-৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। শীতের দুটি প্রিয় সবজি ফুলকপি ও বাঁধাকপির দামও বেড়েছে। বাজারে প্রতি কেজি গরুর মাংস ৫৫০-৫৬০ টাকা, খাঁসির মাংস ৭৫০-৯০০ টাকা, ব্রয়লার মুরগি ১৩০-১৪০ টাকা এবং দেশি জাতের মুরগি ৪৫০-৫০০ টাকা করে বিক্রি হচ্ছে।
সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) ৯ নভেম্বরের তথ্য অনুসারে, গত বছরের শীতের তুলনায় এবার মোটা, মাঝারি ও চিকন চালের দাম যথাক্রমে ৩৬.৭৬, ১৫.৫৬ এবং ১২.৮৭ শতাংশ বেড়েছে।
গত বছরের তুলনায়, মোটা চালের দাম কেজি প্রতি ২৪-৪০ টাকা থেকে বেড়ে ৪৫-৪৮ টাকা, মাঝারি চাল ৪২-৪৮ টাকা থেকে বেড়ে ৪৮-৫৬ টাকা এবং চিকন চালের দাম ৪৫-৫৬ টাকা থেকে বেড়ে ৫৪-৬০ টাকা হয়েছে।
পাশাপাশি, প্রতি কেজি পাম তেলের দাম ৩৬.৩০ শতাংশ বেড়ে ৬৫-৭০ টাকা এবং সয়াবিন তেলের দাম ১৯.৮৮ শতাংশ বেড়ে ৭৬-৮৫ টাকা করে বিক্রি হচ্ছে।
রাষ্ট্র পরিচালিত সংস্থার তথ্যে আরও দেখা যায়, গত বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রতি কেজি মসুর ডালের দাম ৩৫.৭১ শতাংশ এবং আলুর দাম ৭৭.০৮ শতাংশ বেড়েছে। আরও চিনির দাম ৭.৭৬ শতাংশ এবং ইলিশ মাছের দাম ২১.৪৩ শতাংশ বেড়েছে।
ডেমরা এলাকার বাসিন্দা আল-আমিন সিয়াম বলেন, ‘রাজধানীতে প্রতিটি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। শীতকাল আসলেও অন্য সব বছরের তুলনায় সবজির দাম দ্বিগুণ। এক আটি লাল শাক ২০-৩০ টাকা, কচুর লতি ৩০ টাকা, কলমি শাক ২০-২৫ টাকা, ভারতীয় পালং শাক ও ডাঁটা শাকের আঁটি ৩০-৪০ টাকা করে কিনতে হচ্ছে।’
বংশালের বাসিন্দা আমিনা বেগম জানান, কোভিডের কারণে সৃষ্ট আর্থিক সংকটের মধ্যে ক্রমবর্ধমান সবজির দামের কারণে কঠিন সময়ের মাঝ দিয়ে যেতে হচ্ছে।
তিনি বলেন, ‘দাম বাড়ার কারণে আমরা প্রয়োজনীয় শাকসবজি এবং অন্যান্য জিনিসপত্র কিনতে পারি না। নজরদারি ব্যবস্থা শক্তিশালী করে সরকারকে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা উচিত। এছাড়া কৃষকদের আরও বেশি পরিমাণে চাষাবাদে উৎসাহ দেয়া উচিত এবং সরকারকে তাদের আর্থিকভাবে সহায়তা করতে হবে।’
ঢাকার কাঁচাবাজারে আমদানি পেঁয়াজ আসা সত্ত্বেও দাম এখনও না কমায় প্রশ্ন রেখে আমিনা বলেন, ‘সরকার আলুর দাম নির্ধারণ করে দিলেও আমাদের প্রতি কেজি আলু ৪৫-৬০ টাকা এবং পেঁয়াজ ৮০-১০০ টাকায় কিনতে হচ্ছে।’
এদিকে, যথারীতি মহামারির মধ্যে সরবরাহের সংকটকে দায়ী করেছেন ব্যবসায়ীরা।
কারওয়ান বাজারের পাইকারি ব্যবসায়ী আবু ইউসুফ জানান, শিম, ফুলকপি, বাঁধাকপি এবং শীতের অন্যান্য শাকসবজি কাঁচাবাজারে আসতে শুরু করেছে। তবে চাহিদানুসারে সরবরাহের ঘাটতির কারণে সবজির দাম বেড়ে যাচ্ছে। ‘আমরা আশা করছি শিগগিরই দাম কমে আসবে।’
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলেন, সারা বছর ধরে রাজধানীর প্রধান বাজারগুলোতে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম তদারকিতে সরকারি সংস্থাগুলোকে কাজ করতে হবে।
তিনি বলেন, কৃষি সম্পর্কিত বিভাগগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এবং কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরসহ (ডিএই) সংস্থাগুলোর কোনো তথ্য উপাত্তের মিল নেই। এ কারণেই এখানে প্রয়োজনীয় দ্রব্যের সরবরাহের অনুমান করা কঠিন। আর, সিন্ডিকেটরা এ সুযোগটাই কাজে লাগাচ্ছে।
বাংলাদেশের পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুরের মতে, ‘করোনাভাইরাস মহামারিতে অক্টোবর মাসের ৬.৪৪ শতাংশ মুদ্রাস্ফীতি গত সাত বছরে মধ্যে সর্বোচ্চ ছিল। গ্রামাঞ্চলে মূল্যস্ফীতি ছিল ৬.৬৭ শতাংশ, আর শহরাঞ্চলে ছিল ৬.৩ শতাংশ। সেপ্টেম্বরে সাধারণ মূল্যস্ফীতি ছিল ৫.৯৭ এবং খাদ্যের মূল্যস্ফীতি ছিল ৬.৩ শতাংশ।’
দেশের ২.২৩ লাখ হেক্টর অনাবদি জমিতে চাষাবাদের পরামর্শ দিয়ে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি শামস মাহমুদ বলেন, ন্যায্যদাম নিশ্চিত করতে মৎস্য উৎপাদন, হাঁস-মুরগি ও দুগ্ধ শিল্পে জড়িত ছোট উদ্যোক্তাদের ভ্যালু চেইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে।
প্রশিক্ষণসহ কৃষি খাতে উন্নত কৃষি অনুশীলন (জিএপি) নিশ্চিতকরণে কৃষকদের আর্থিক অনুদান, নীতিগত সমর্থন এবং বিএসটিআইকে শক্তিশালীকরণসহ বিশেষায়িত প্রযুক্তি নির্ভর আধুনিক সরবরাহ চেইনের অবকাঠামো প্রতিষ্ঠার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
বাজার গবেষণা এবং বেসরকারি খাতের উৎপাদক এবং প্রক্রিয়াজাতকারকদের সক্ষমতা বাড়ানোর পক্ষ নিয়ে মাহমুদ বলেন, কৃষি প্রক্রিয়াকরণ ব্যবসায় বেসরকারি খাত এবং বৈদেশিক বিনিয়োগ কৃষি পণ্য বৈচিত্র্যায়ন, উদ্ভাবন এবং নতুন বাজার প্রসারণে সহায়তা করবে।